বাংলাদেশে বেকার সমস্যা : কারণ ও প্রতিকার

 বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সমস্যা ও সমাধান

বেকার সমস্যা


বাংলাদেশে বেকারত্ব একটি মারাত্মক সামাজিক সমস্যা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেকারত্ব বিভিন্নভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতার পর আমাদের দেশে বেকার সমস্যা অপ্রত্যাশিত গতিতে বেড়ে চলেছে। এ সমস্যা সচেতন মহলকে আতঙ্কিত ও হতাশাগ্রস্ত করেছে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই এ সমস্যার মূলােৎপাটন করে জাতিকে বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। 


বেকারত্বের ধারণা :

সাধারণ অর্থে বেকারত্ব বলতে কোনাে সমাজে কর্মক্ষম লােকের জন্য কাজের অভাব বা কর্মসংস্থানের অভাবকে বােঝানাে হয়। কর্মক্ষম জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য অনুসারে তাদের যােগ্যতার ভিত্তিতে যদি সমাজে পর্যাপ্ত পরিমাণে কাজ না থাকে, যার প্রভাবে জনগণ ভবঘুরেভাবে বা অলসভাবে অন্যের বােঝা হয়ে সমাজে বসবাস করে, তাদের বেকার বলা হয়। বেকারত্ব সমাজের জন্য একটি অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি ও অভিশাপস্বরূপ। কাজেই এর দূরীকরণ একান্ত জরুরি। অধ্যাপক পিগুর মতে, যখন কর্মক্ষম জনগণ তাদের যােগ্যতা অনুসারে প্রচলিত মজুরির ভিত্তিতে কাজ করতে চায়, অথচ কাজ পায় না, সে অবস্থাকেই বেকারত্ব বলা হয়। অর্থনীতি ও সামাজিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, বেকারত্ব বলতে এমন ধরনের একটি পরিস্থিতি বা অবস্থাকে বােঝায়, যেখানে কর্মক্ষম জনগােষ্ঠী প্রচলিত মজুরিতে কাজ করতে ইচ্ছুক থাকা সত্ত্বেও কাজে যােগদান করতে পারে না। কর্মক্ষম শ্রমিক বা জনগােষ্ঠীর অনিচ্ছাকৃত বেকার থাকাকেই বেকারত্ব বলা হয়।

ওপরের সংজ্ঞাগুলাের আলােকে বলা যায় যে, বেকারত্ব বলতে এমন এক অবস্থাকে বােঝায়, যার ফলে কোনাে দেশের অসংখ্য কর্মক্ষম লােক কর্মে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের সুযােগ লাভ থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি বিভিন্নভাবে ব্যাহত হয়। 


বাংলাদেশে বেকার সমস্যার কারণ : 

বাংলাদেশে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং সে অনুসারে সম্পদ ও কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি না হওয়ায় বেকার সমস্যা দিন দিন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ২০১২ সালের অর্থনৈতিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশে মােট শ্রমশক্তি (১৫ বছর+) ৫ কোটি ৬৭ লাখ ।। CIA World Fact Book-এর তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ২.৫০% যা বিশ্ব বেকারত্বের র্যাংকিং এ বাংলাদেশের ১৯তম অবস্থানকে সুনির্দিষ্ট এসব বেকারত্বের পেছনে একক কোনাে কারণকে দায়ী করা যায় না। বরং বেকার সমস্যার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। বাংলাদেশে বেকারত্বের জন্য যেসব কারণগুলাে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে দায়ী সেগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে : 

১. অনুন্নত ও প্রাচীনপন্থী কৃষিব্যবস্থা : 

বাংলাদেশের বেকারত্বের জন্য অনুন্নত ও সনাতন কৃষিব্যবস্থা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। এ দেশে এখনাে মান্ধাতার আমলের কাঠের লাঙল ও দুর্বল বলদ দিয়ে জমি চাষ করা হয়। ফলে উৎপাদন আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পায় না। এতে মৌসুমী ও ছদ্মবেশী বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। তাছাড়া বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থা অনেকাংশেই মৌসুমী জলবায়ুর ওপর নির্ভর করে। ফলে সৌভাগ্যবশত সময়মতাে বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলে ফলন ভালাে হয় আর বিপরীত হলে জনগণের দুঃখের সীমা থাকে না। আর এ কারণেই বাংলাদেশে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । 

২.দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামাে : 

দুর্বল ও অসচ্ছল অর্থনৈতিক কাঠামাে বাংলাদেশের বেকারত্বের জন্য দায়ী। বাংলাদেশ সরকারও জনগণের বেকারত্বের জন্য দায়ী বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের ব্যক্তিগত পর্যায়ে অর্থনৈতিক কাঠামাে এতই দুর্বল যে, কারাে পক্ষেই বৃহৎ উৎপাদন শিল্পে মূলধন বিনিয়ােগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ কারণে ক্রমবর্ধমান বেকারদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা সম্ভব হয় না। তাই দুর্বল অর্থনৈতিক কাঠামাে স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বেকারদের সংখ্যা হ্রাস করতে পারে না। 

৩. শিল্পে অনগ্রসরতা : 

বর্তমান বিশ্বে কতিপয় দেশে দ্রুত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তুবাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে না। ফলে বর্ধিত লােকদের জন্য কোনােভাবেই কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না। তাছাড়া কুটির শিল্পের অবলুপ্তিও বাংলাদেশে বেকার সমস্যাকে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি করেছে। 

৪. কারিগরি জ্ঞানের অভাব : 

আধুনিক প্রযুক্তি ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে বাংলাদেশের শ্রমশক্তি কর্মসংস্থানের সুযােগ লাভ করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। কারণ শিল্প-কারখানায় নিয়ােগ লাভের জন্য কারিগরি জ্ঞানের খুবই প্রয়ােজন। কিন্তু এ দেশের শ্রমশক্তির এক বিরাট অংশের সে জ্ঞান না থাকায় তাদের অধিকাংশই বেকার জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। 

৫. মূলধনের অভাব : 

বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ দরিদ্র। যারা দরিদ্র নয় তাদের অনেকেরই আবার সঞ্চয় করার মতাে আর্থিক সঙ্গতি নেই। আর সঞ্চয় না থাকলে শিল্প-কারখানায় বিনিয়ােগের জন্য মূলধন সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। তাই প্রয়ােজনীয় মূলধনের অভাবে এখানে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি অনেকে বেকার জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে।

৬. নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা : 

নিরক্ষরতা ও অজ্ঞতা বাংলাদেশের বেকারত্বের একটি মৌলিক কারণ। উপযুক্ত শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাবে অনেকেই নিজেকে কোনাে কাজে নিয়ােজিত করতে পারে না। ফলে অনেকেই বেকার জীবনযাপন করতে বাধ্য হয়। 

৭. ক্রটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা : 

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট ক্রটিপূর্ণ। বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা  বেকারত্ব সৃষ্টির জন্য বহুলাংশে দায়ী। কারণ সাধারণ শিক্ষা উৎপাদনমুখী না হওয়ায় এ শিক্ষায় কেরানি বা এ ধরনের কাজ ছাড়া অন্য ধরনের, বিশেষ করে উৎপাদনমুখী কাজের উপযােগী হয় না। সাধারণ কাজের সুযােগ সীমিত হওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৮. প্রাকৃতিক দুর্যোগ : 

বাংলাদেশে প্রতি বছর নদীভাঙন, বন্যা, জলােচ্ছ্বাস, খরা, পােকামাকড়ের আক্রমণ প্রভৃতি আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে বিপুল পরিমাণ কৃষি শ্রমিক বেকারত্বের শিকার হচ্ছে। 

৯. জনসংখ্যা বিস্ফোরণ : 

জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বর্তমানে বাংলাদেশের এক নম্বর সামাজিক সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত। জনসংখ্যা বিস্ফোণের ফলে কর্মসংস্থানসহ অনান্য সুযােগ-সুবিধার ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি বিভিন্নভাবে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি করছে। 

১০. অদক্ষ জনশক্তি : 

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের অভাব, দক্ষতা ও  অভিজ্ঞতার অভাব আমাদের দেশের জনশক্তির একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য। উপযুক্ত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাবে তারা বিভিন্ন ধরনের কাজের সুযােগ থেকে বঞ্চিত হয় ফলে বেকারত্বের অভিশাপ তাদের হাতছানি দেয়।

১১. মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গি : 

মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশে বেকারত্ব সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে দায়ী। বংশগত মর্যাদা, উচ্চ শিক্ষা প্রভৃতি কারণে অনেকে নিম্নমানের কাজ করতে রাজি হয় না। ফলে তারা বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা ও অন্তরায়ের সৃষ্টি করে। 

১২. নারী কর্মসংস্থানের প্রতিবন্ধকতা : 

বাংলাদেশে পর্দাপ্রথা, সামাজিক মূল্যবােধ, অশিক্ষা, পরিবারের চাপ প্রভৃতি কারণে নারীরা বাইরের জগতের সাথে নিজেদের সংযুক্ত করতে পারে না অথচ দেশের মােট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী। কাজের প্রতি মহিলাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ মহিলাদের বেকার করে রেখেছে। 

১৩.শ্রমিক ছাঁটাই : 

বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার।ঘন ঘন শ্রমিক ছাঁটাই বাংলাদেশে বেকার সমস্যাকে জটিল করে তুলছে। অদক্ষ শ্রমিকগণ কোনাে কারণে শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে ছাঁটাই হলে দক্ষতার অভাবে অন্য কোনাে কাজ যােগাড় করতে নাপেরে বেকার হয়ে পড়ে।

১৪.অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টি : 

বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগােষ্ঠীর এক বিরাট অংশ অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টিজনিত সমস্যার শিকার। ফলে তারা দিন দিন তাদের কর্মক্ষমতা হারিয়ে বেকারত্বের শিকার হচ্ছে। 

১৫. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : 

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বেকার সমস্যার একটি অন্যতম কারণ। স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ঘন ঘন প্রশাসনিক রদবদলের ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামাে ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অক্ষম। এছাড়া রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে হরতাল, ধর্মঘট, ভাঙচুর ও অবরোধে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

১৬ চাকুরি নিয়ােগ অধ্যাদেশ : 

মাঝে মাঝে সরকার চাকুরি নিয়ােগ অধ্যাদেশ জারি করে চাকরিতে  সাময়িকভাবে নিয়ােগ বন্ধ রাখে এতেও বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। 

১৭ বিদেশী সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা : 

বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি অনেকাংশে বিদেশী ঋণ ও সাহায্যের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বিদেশীরা কর্মসংস্থান সৃষ্টির ওপর ঋণ ও সাহায্য দিতে রাজি হয় না বলে দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা যায় না। ফলে দেশে বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

১৮.দারিদ্রের দুষ্টচক্র : 

বাংলাদেশের অর্থনীতি দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের মধ্যে আটকে রয়েছে। দারিদ্র্যের প্রভাবে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় না হওয়ায় মূলধন গঠিত হচ্ছে না। মূলধনের ঘাটতি এবং কার্যকর চাহিদার অভাবে বিনিয়ােগ ব্যাহত হয়ে কর্মসংস্থানের সুযােগ ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। 

১৯.শ্রমিকদের গতিশীলতার অভাব : 

বাংলাদেশের শ্রমিকদের শিক্ষা ও দক্ষতার অভাব, প্রশিক্ষণের অভাব, আর্থিক অসঙ্গতি ও উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার অভাবে গতিশীলতা হ্রাস পায়। ফলে বেকারত্বের সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

২০.ধর্মান্ধতা ও ফতােয়াবাজি : 

বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্মান্ধতা ও ফতােয়াবাজির প্রভাবে অনেক মহিলা বিভিন্ন কাজকর্ম করতে সক্ষম হচ্ছে না। ফলে গ্রাম এলাকায় মহিলাদের মধ্যেও বেকারত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 


বাংলাদেশে বেকারত্বের প্রভাব : 

বাংলাদেশে সমাজের সর্বত্র বেকারত্ব ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সমাজের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতির পথে বেকারত্ব সব সময় অন্তরায় সৃষ্টি করে। বেকারত্ব বর্তমানে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনকে অভিশপ্ত ও বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বেকারত্বের ক্ষতিকর প্রভাবগুলাে নিচে আলােচনা করা হলাে : 

১. নির্ভরশীলতার সংখ্যা বৃদ্ধি : 

বেকারত্ব আমাদের সমাজে বিপুল পরিমাণে নির্ভরশীলতার সংখ্যা বৃদ্ধি করছে। ফলে নির্ভরশীল ব্যক্তিরা বেকার জীবনের অভিশাপ নিয়ে সমাজের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে। এভাবে সামাজিক প্রথা, মূল্যবােধ, রীতিনীতি প্রভৃতির বন্ধন প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের দেশের জাতীয় সম্পদেরও বিপুল পরিমাণে অপচয় হচ্ছে। 

২. মৌলিক চাহিদা পূরণে অন্তরায় : 

বেকারত্ব আমাদের দেশে মৌলিক মানবিক চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। বেকারত্বের কারণে অনেকে কোনাে প্রকার কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করতে পারছে না বলে তাদের তেমন কোনাে আয় হচ্ছে না যার দ্বারা নিজেদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনােদনসহ বিভিন্ন প্রকার চাহিদা পূরণ করতে পারে। 

৩. জাতীয় উৎপাদন ও আয় হ্রাস : 

বেকারত্ব আমাদের জাতীয় উৎপাদন ও আয়ের ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। উপার্জন না থাকায় মূলধনের অভাবে অনেকে কোনাে প্রকার উৎপাদনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারছে না। ফলে বেকারত্বের প্রভাবে মানুষের উৎপাদন ক্ষমতা ও জাতীয় আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। 

৪. দরিদ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি : 

বেকারত্ব আমাদের দেশে দরিদ্রের সংখ্যা ও গভীরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করে চলছে। বর্তমানে এ দেশের শতকরা প্রায় ৪০% ভাগ লােক দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে। বেকারত্বের কারণে অনেকের পক্ষেই এ দারিদ্র্যদশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না।

৫. সামাজিক সংঘাত : 

বেকারত্ব আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করছে। আর হতাশার কারণে অনেকের মধ্যেই জীবন সম্পর্কে অনীহা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং জীবনের মূল্য হ্রাস পাচ্ছে। ফলে সামাজিক সংঘাত ও কলহ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৬. অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি : 

বেকারত্ব আমাদের দেশে অপরাধমূলক কার্যক্রমের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি প্রভৃতি অপরাধমূলক কার্যক্রম একমাত্র বেকারত্বের কারণেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

৭. সামাজিক বন্ধন ছিন্ন : 

বেকারত্ব আমাদের দেশে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন ছিন্ন করছে। পরিবারিক ভাঙনে যৌতুকের মাধ্যমে নারী নির্যাতন, বিবাহ বিচ্ছেদ, আত্মহত্যা, পতিতাবৃত্তি প্রভৃতি অসামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করে সামাজিক পরিবেশকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। 

৮. সামাজিক অনিশ্চয়তা : 

বেকারত্বের কারণে যুবসমাজের মধ্যে চরম হতাশা ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে। ফলে দেশের প্রতি সমাজের প্রতি ও সামাজিক আইনের প্রতি তাদের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমে হাস পাচ্ছে। এভাবে সমাজব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। 

৯. মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধি : 

বাংলাদেশে মাদকাসক্তির হার বৃদ্ধির পেছনে বেকারত্বের প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বেকারত্বের হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্য অনেকেই মাদকদ্রব্যের ওপর আসক্ত হয়ে পড়ছে।

১০.অন্যান্য সমস্যা : 

সর্বোপরি বেকারত্বের প্রভাবে বাংলাদেশে স্বাস্থ্যহীনতা, পুষ্টিহীনতা, অজ্ঞতা, অশিক্ষা, নিরক্ষরতাসহ বহু ধরনের সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 


বেকার সমস্যা প্রতিকারের উপায় : 

বেকার সমস্যা বাংলাদেশের অন্যতম জটিল সামাজিক সমস্যা। এ সমস্যা আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। এ সমস্যার সমাধান করতে পারলে দেশের সার্বিক উন্নতি ও অগ্রগতি ত্বরান্বিত করা সম্ভব হবে না। বেকার সমস্যা সমাধান করতে হলে দেশে ও বিদেশে ব্যাপকহারে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ কার্যক্রমের মাধ্যমে বেকার সমস্যা মােকাবিলা করা সম্ভব। বাংলাদেশে বেকার সমস্যা প্রতিকারের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায় : 

১. বেকার সমস্যা সমাধানের জন্য বাস্তবমুখী পদ্ধতি প্রয়ােগ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। 

২. কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি, কৌশল ও যন্ত্রপাতি প্রয়ােগ করে কৃষির সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। 

৩. শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপক বিনিয়ােগ করতে হবে এবং শিল্পের সম্প্রসারণ করতে হবে

৪. সুনির্দিষ্ট জাতীয় শ্রমনীতি, কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। 

৫. গ্রাম, শহরভেদে সর্বস্তরে ও সর্বস্থানে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে।

৬. বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টি, আত্মকর্মসংস্থান কর্মসূচি এবং কুটির শিল্প স্থাপনসহ বিভিন্ন _ ধরনের নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বেকার সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। 

৭. উৎপাদনমুখী শিক্ষা, জনগণের দক্ষতা বৃদ্ধি, মূল্যবােধ ও দৃষ্টিভঙ্গির গঠনমূলক পরিবর্তন সাধন। করে এ সমস্যার মােকাবিলা করা যায়। 

৮. প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বেকার সমস্যার মােকাবিলা করা সম্ভব।

৯. ধর্মীয় গোঁড়ামি দূর করে ফতােয়াবাজদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করেও বেকার সমস্যা সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া যায়। 

১০. নারী শিক্ষার অনুকূল সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি এবং উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরির মাধ্যমে বেকার সমস্যা অনেকটা হ্রাস করা সম্ভব। 

১১. গ্রামীণ আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে পার্শ্বজীবিকার ব্যবস্থা করে বেকার সমস্যা মােকাবিলার জন্য | প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নেয়া যায়। 

১২. সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিরােধীদলীয় নেতবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনা করে ঐক্যবদ্ধভাবে বেকার সমস্যা সমাধানের প্রয়াস নেয়া যায়। 

১৩. সামাজিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষা প্রদান করে জনগণকে সচেতন করে তােলার মাধ্যমে। উপযুক্ত শ্রমশক্তি তৈরি করে বেকার সমস্যার সমাধান করা যায়। 

১৪. স্বল্প পুঁজি বিনিয়ােগের মাধ্যমে ছােট ছােট স্বকর্ম প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণের বেকারত্ব হাস করা সম্ভব। 

১৫. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা কর্মসূচির সম্প্রসারণের মাধ্যমেও বেকার সমস্যার সমাধান করা যায়। 


ওপরের আলােচনার প্রেক্ষাপটে বলা যায় যে, বেকারত্ব বাংলাদেশের শুধু একক কোনাে সমস্যা নয় বরং অন্যান্য বহু সমস্যার প্রত্যক্ষ কারণও বটে। এ সমস্যার পেছনে বহুবিধ কারণ বিদ্যমান। এ সমস্যা আমাদের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। কাজেই একক কোনাে পদ্ধতি বা কর্মসূচি প্রয়ােগ করে এ সমস্যার মােকাবিলা করা সম্ভব নয়। ববং সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যৌথ উদ্যোগে এ সমস্যার মােকাবিলা করতে হবে।



Post a Comment

0 Comments