বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন: সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলো আলোচনা

Obstacles and Possibilities of Economic Development of Bangladesh

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মােকাবিলায় আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় আন্তর্জাতিক স্রোতধারায় সম্পৃক্ত হবার মধ্য দিয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্য এবং নিরক্ষরতামুক্ত নতুন বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। নিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বস্তুত স্নায়ুযুদ্ধের অবসানে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তনের সুযােগ এনে। দিয়েছে। বিশ্বায়নের (Globalisation) কারণে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় একটি অভিন্ন। অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিযােগিতাপূর্ণ বাজার ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাসমূহ যথাযথভাবে চিহ্নিত করে তা সমাধানের সঠিক দিকনির্দেশনা উদ্ভাবন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 


অর্থনৈতিক উন্নয়ন : 

উন্নয়নের সংজ্ঞা ও সূচক বহুমাত্রিক এবং দ্ব্যর্থবােধক। এ সম্বন্ধে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিশ্লেষণ। ভিন্নতা সত্ত্বেও আমরা ক্রমপরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একক বিশ্বব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। সাধারণভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বলতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বােঝানাে হয়। কেউ কেউ আর্থ-সামাজিক অবকাঠামােগত রূপান্তরকে উন্নয়ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন—সামন্তবাদ থেকে পুঁজিবাদে রূপান্তর। 


প্রখ্যাত উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ ইয়ং (Young, ১৯৮৯)-এর মতে, উন্নয়ন হলাে কোনাে ব্যক্তি বা সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির একটি জটিল প্রক্রিয়া। 


নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন-এর মতে, উন্নয়ন মানে মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন, যে মান তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য বা আয়ু এবং আরাে অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আয় বৃদ্ধি সে লক্ষ্যে পৌছানাের একটি উপায় মাত্র। তার মতে, আয় বৃদ্ধি বা উৎপাদনের ওপর মানুষের অধিকার বা এনটাইটেলমেন্টের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। অমর্ত্য সেন উন্নয়নের আবশ্যিক পাঁচটি শর্তের কথা বলেছেন :

১. সামাজিক, 

২. রাজনৈতিক, 

৩. বাজার ব্যবস্থা, 

৪. পদ্ধতিগত সুযােগ এবং 

৫. অসহায় শ্রেণীর সুরক্ষার স্বাধীনতা। 


অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমস্যাসমূহ : 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান সমস্যাসমূহ নিম্নরূপ : 

১. অবকাঠামােগত দুর্বলতা : 

বাংলাদেশ সফর শেষে বিশ্বব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি বিকাশের পথে প্রধান বাধা হচ্ছে অবকাঠামােগত দুর্বলতা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দৃঢ় ভিতের অবকাঠামাে দরকার। ভিত না থাকলে যেমন ইমারত তােলা যায় না, তেমনি অর্থনীতি দাঁড়াবার জন্য অবকাঠামাে দরকার। ট্যাক্স বা শুল্ক রেয়াত, মুদ্রা বিনিময়ের সুবিধা। এবং অন্যান্য সুবিধা যাই দেয়া হােক, অবকাঠামাে ঠিক না থাকলে উদ্যোক্তাদের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থৈকে যাওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে অর্থনীতির গতিশীলতা ব্যাহত হয়।


২. ঋণখেলাপিদের দৌরাত্ম্য : 

ঋণখেলাপিরা আমাদের অর্থনীতির প্রধান শত্রু খেলাপি ঋণ। আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রার পথে প্রধান বাধা। ঋণগ্রহীতারা নানা প্রভাব-প্রতিপত্তির মাধ্যমে বিনিয়ােগের নামে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নির্ধারিত খাতে বিনিয়ােগ না করে অন্য অনুৎপাদন খাতে বিনিয়ােগ করে। এই খেলাপি ঋণের হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়মিত পরিশােধ হলে উক্ত টাকা পুনঃবিনিয়ােগের মাধ্যমে জাতীয় অর্থনীতি লাভবান হতাে। কিন্তু ঋণখেলাপি হবার ফলে দেশ সমৃদ্ধির সে সুযােগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। 


৩. বৈদেশিক সাহায্য ও উন্নয়ন : 

বৈদেশিক সাহায্য আদৌ জাতীয় উন্নয়নে কোনাে অবদান রাখতে পারে কিনা— এ নিয়ে খােদ দাতা দেশগুলােতেও দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছে। দাতা দেশগুলােতেও এ কথা শােনা যাচ্ছে যে, বৈদেশিক সাহায্য তৃতীয় বিশ্বের কোনাে উন্নয়নে আসছে। প্রসঙ্গক্রমে জার্মান পার্লামেন্টের একজন সদস্যা বিগ্রেতে এরলারের নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। তিনি বাংলাদেশে জার্মান সাহায্য সম্পর্কিত বিষয়াদি নিয়ে একটি বই লিখেন, যার নাম ছিল 'Toedliche Hilfe' অর্থাৎ সাহায্য যা মৃত্যুর সমতুল্য। মিসেস এরলার উক্ত বইয়ে দেখিয়েছিলেন, কিভাবে সাহায্য অপচয় হচ্ছে, কিভাবে তথাকথিত কনসালটেন্সির নাম করে ঋণের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে জার্মান ফার্মের পকেটে। ব্রিগেতে এরলারের বইটি হচ্ছে আমাদের কাছে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ যে, বৈদেশিক সাহায্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করছে। 


৪. বিদেশী পণ্যের আধিপত্য : 

বর্তমানে বাংলাদেশের বাজার বিদেশী পণ্যে সয়লাব। এ ঘটনা দেশী-বিদেশী উদ্যোক্তাদের হতাশ করেছে। বিদেশী বিনিয়ােগকারীরা যখন কোনাে দেশে বিনিয়ােগ করতে আসেন, তখন স্থানীয় বাজারের সম্ভাবনা যাচাই করেন। সুতরাং বাংলাদেশের। বাজারে বিদেশী পণ্যের আধিপত্য আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মারাত্মক অন্তরায়। 


৫. কম সঞ্চয় : 

একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ১৬% থেকে ২০% জাতীয় সঞ্চয়ের। প্রয়ােজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশে বর্তমান জাতীয় সঞ্চয়ের পরিমাণ মাত্র। ৮%। সুতরাং জাতীয় সঞ্চয়ের এই নিম্নমান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি বিরাট সমস্যা। 


৬. আমদানি নির্ভরতা : 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে রপ্তানির তুলনায় আমদানির আধিক্যের কারণে বাণিজ্যিক লেনদেনের ভারসাম্যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়। ২০১০-১১ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ। সময়ে দেশে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৪৮৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ আমদানি নির্ভরতা । তথা বাণিজ্যিক ঘাটতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। 


৭. প্রশাসনিক জটিলতা : 

বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের চালিকাশক্তি রাজনৈতিক প্রকৃতির হলেও মূল কাজকর্ম পরিচালনা করে আমলারা। সংসদে মন্ত্রীদের যেসব প্রশ্ন করা হয় তার উত্তরও লিখে দেন। আমলারা। সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি, তাও প্রণয়ন করেন সম্পূর্ণরূপে আমলারা। UNDP-এর সাম্প্রতিক এক রিপাের্ট বলা হয়, বাংলাদেশে। আমলাতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃত্বের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি নয়। গতিশীল রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও নেতৃত্বের অভাব বাংলাদেশে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা সৃষ্টি করেছে। ফলে বিদেশী বিনিয়ােগকারীরা। উৎসাহী হচ্ছে না এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।


৮. প্রতিকূল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি : 

বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মােটেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পক্ষে অনুকূল নয়, যা পুঁজি বিনিয়ােগের প্রধান অন্তরায়। বিদেশী বিনিয়ােগকারী দল। বিনিয়ােগের পরিবেশ দেখার জন্য বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ বিমান বন্দরে পৌছলে কিছু অসাধু কর্মকর্তা তাদের সাথে অশালীন আচরণ করে। ফলে ঐ বিনিয়ােগকারী দল বিমানবন্দর থেকেই তাদের দেশে ফিরে যায়, যা আমাদের জন্য শুধু দুঃখজনক নয়, লজ্জাজনকও বটে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ অবনতি বাংলাদেশের অর্থনীতির পথে হুমকিস্বরূপ। 


৯. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা : 

বলা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক উন্নয়ন অর্থনৈতিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কিন্তু বাংলাদেশে সরকারি ও বিরােধী দলসমূহের নিম্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার ফলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্টহীন ইস্যুতে বিরােধী। দলসমূহের একটানা সংসদ বর্জন সংসদীয় রীতি বিবােধী এবং দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। 


১০.দুর্নীতি : 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক কূটনীতি সফল করতে স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন অপরিহার্য। কিন্তু বাংলাদেশে এর উপস্থিতি অতি নগণ্য। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ায় সংস্কারের অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ করণীয় শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বিশ্ববাংকের দক্ষিণ এশীয় বিভাগের অর্থনীতিবিদ বলেছেন, বাংলাদেশের দুর্নীতির স্তর এক ধাপ কমাতে পারলে বিনিয়ােগ বাড়বে GDP-র ৪ শতাংশ এবং GDP-র প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি পাবে ০.৫ শতাংশ। এতেই স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এদেশে দুর্নীতির শিকড় কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। Transperancy International-এর প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মূল অন্তরায় হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। 


১১. নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরগতি : 

নীতি বাস্তবায়নে সরকারের ধীরগতির কারণেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বিশ্বব্যাংকের সাতজন নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশ সফর। শেষে এক রিপাের্ট তৈরি করেন। রিপাের্টে সরকারের নীতি বাস্তবায়নে ধীরগতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয় এবং এ ধীরগতিকে অর্থনৈতিক উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। 


অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা:

১. বৈদেশিক বিনিয়োগ সম্ভাবনা:

Bangladesh 2020 : A Long Run Perspective Study' শীর্ষক সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাংকের এক দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত সমীক্ষা রিপাের্ট অনুযায়ী, আগামী ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশে কমপক্ষে ৮০০ কোটি মার্কিন ডলারের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়ােগ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। চলতি বিনিময় হার অনুযায়ী স্থানীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। উক্ত রিপাের্টে বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ পর্যায়ে বৈদিশিক বিনিয়ােগ আহরণের জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতি ও রেগুলেটরি পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, মানব ও প্রাকৃতিক সম্পদের টেকসই উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। যদি তা করা হয়, তবে বাংলাদেশের সামনে রয়েছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। আলােচনার সুবিধার্থে বৈদেশিক বিনিয়ােগ সম্পর্কিত বিষয়টিকে নিম্নোক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচন করা হলাে : 


ক. তেল ও গ্যাসক্ষেত্রে বিনিয়ােগের সম্ভাবনা : 

বিনিয়ােগ বাের্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান। আনিসুল হক চৌধুরী বলেছেন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশ বাংলাদেশে তেল ও গ্যাস খাতে বিনিয়ােগের জন্য প্রস্তুত। তাদের মতে, এটা বিপুল সম্ভাবনাময়। এদিকে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের Energy Sector-এ মার্কিন কোম্পানিগুলাের সরাসরি বিনিয়ে উন্নীত হয় এবং অতিরিক্ত হিসাবে আরাে কয়েক মিলিয়ন ডলার বিনিয়ােগের অপেক্ষায় আছে। 'Bangladesh 2020 : A Long Run Perspective Study' শীর্ষক রিপাের্টটিতেও বলা হয়, প্রাকৃতিক গ্যাস খাতে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়ােগের পরিমাণ আগামী ৪ বছরে ১০ কোটি ডলারে পৌঁছতে পারে, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হতে সমর্থন যােগায়। 


খ. বস্ত্রশিল্পে বিনিয়ােগের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের সিংহভাগ অর্জনকারী শিল্পের মধ্যে বস্ত্রশিল্প অন্যতম। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পােশাকের বিপুল চাহিদা। থাকায় দেশী-বিদেশী প্রচুর বিনিয়ােগকারী বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প পুঁজি বিনিয়ােগের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বস্ত্রশিল্প তীব্র প্রতিযােগিতার সম্মুখীন হলেও দেশী-বিদেশী বিনিয়ােগকারী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে এ খাতের অবদান বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে উত্তরােত্তর গতিতে বৃদ্ধি পেতে সক্ষম হবে। 


গ. ইপিজেডে বিনিয়ােগের সম্ভাবনা : 

বৈদেশিক বিনিয়ােগের অন্যতম সম্ভাবনা হলাে ইপিজেড এলাকায় বিনিয়ােগ। ইউরােপ, আমেরিকাসহ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের বিনিয়ােগকারীরা। বাংলাদেশের ইপিজেড এলাকায় শিল্পাঞ্চল গড়ে তােলার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাই বিনিয়ােগকারীদের ক্রমাগত চাহিদা মেটাতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ইপিজেড সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। এছাড়া দেশে আরাে চারটি নতুন ইপিজেড নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তীরে ইপিজেড নির্মাণ করছে। এ থেকে অনুমান করা যায়, বাংলাদেশ এখন শিল্পযুগে পদার্পণ করেছে এবং দেশে দ্রুত শিল্পায়নের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। 


ঘ. কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়ােগের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কৃষির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ সফরকালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফিদেল রামােস বলেছিলেন, কৃষি ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে বিনিয়ােগের অপার সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশে। উচ্চ ফলনশীল ধানবীজের ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রায়। স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এছাড়া সাম্প্রতিককালে তেলবীজ, আখ, তুলা, আলু ও গম উৎপাদন বুদ্ধি পেয়েছে নাটকীয়ভাবে। তাই বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষিক্ষেত্রে বিনিয়ােগের যে অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এতে দ্বিমতের কোনাে অবকাশ নেই। 


২. জনশক্তি রপ্তানির সম্ভাবনা : 

জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হতে পারে বাংলাদেশের জন্য অসীম সম্ভাবনাময় বাজার । দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নার্স ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদদের বিপুল চাহিদা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা অনুযায়ী নার্স ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ পাঠাতে পারলে বাংলাদেশ বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারবে। জাপান, জার্মানির মতাে তাইওয়ানও বাংলাদেশের জন্য বেশ সম্ভাবনাময় বাজার। উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ সহজেই তাইওয়ানের শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের বিশেষ চাহিদা রয়েছে দ্বীপরাষ্ট্র মরিশাসে। জার্মানিসহ ইউরােপের শিল্পোন্নত দেশসমূহ হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বাংলাদেশ থেকে দক্ষ তথ্যপ্রযুক্তিবিদ নেয়ার জন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরকার পরিকল্পিতভাবে উদ্যোগী হলে দেশের বিশাল বেকার জনগােষ্ঠীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনশক্তিতে রূপান্তর করে বিদেশে রপ্তানির দ্বারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতিকে আরাে ত্বরান্বিত করতে পারে।


৩. সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক সম্পদ : 

প্রাকৃতিক সম্পদ একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে দেশ প্রাকৃতিক সম্পদে যত পরিপূর্ণ সে দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে তত সমৃদ্ধশালী। বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনা বেশ উজ্জ্বল । জ্বালানি ও খনিজ সম্পদের মধ্যে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, চুনাপাথর, চীনামাটি, কঠিন শিলা, খনিজ বালি, কাঁচা বালি। ও খনিজ তৈল বেশ সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। দেশে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, তাপমাত্রার বিপর্যয় রােধ ও মানবিক চাহিদা মেটানাের সাথে সাথে অর্থনৈতিক উন্নয়নে বনজ সম্পদের গুরুত্বও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। 


৪. মৎস্য সম্পদের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস্য সম্পদের গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশ ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ৭২৮৮৯ মেট্রিক টন এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে ৭৭৬৪৩। মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করে যথাক্রমে ৩২৪৩.৫১ কোটি টাকা এবং ৩৪০৮.৫২ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। মৎস্য সম্পদের মধ্যে চিংড়ি সম্পদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে মােট ৬৭টি প্রজাতির চিংড়ির মধ্যে প্রধানত দুটি প্রজাতির চিংড়ি বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী হিসেবে পরিচিত। এগুলাে হচ্ছে মিঠা পানির গলদা এবং লােনা পানির বাগদা। বিশ্ব বাজারে গলদা চিংড়ি Giant fress water prawn এবং বাগদা চিংড়ি Giant tiger prawn নামে পরিচিত। তবে বাংলাদেশে যে পরিমাণ চিংড়ি উৎপাদিত হয় তা সঠিক কোনাে ব্যবস্থাপনা ছাড়াই হচ্ছে। যথাযথ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চিংড়ি উৎপাদন ও রপ্তানি সম্ভব হলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সম্পদ সুদূরপ্রসারী অবদান রাখতে পারবে। 


৫. সামুদ্রিক সম্পদের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গোপসাগরের কূল ঘেঁষে ৭১১ কি.মি. উপকূল রেখা রয়েছে। উপকূল ভাগ থেকে সমুদ্রের অভ্যন্তরের ৩২২ কি.মি. পর্যন্ত সামুদ্রিক সম্পদে পরিপূর্ণ। মৎস্য ছাড়াও এসব সম্পদের মধ্যে রয়েছে মুক্তা, প্রবাল, নুড়ি পাথর, ঝিনুক, শামুক ইত্যাদি। এছাড়া উপকূলে রয়েছে জিরকন, মােনাজাইট প্রভৃতি খনিজ সম্পদ। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এসব সম্পদের রয়েছে উজ্জ্বল সম্ভাবনা, যে কারণে এসব সামুদ্রিক সম্পদকে কালাে সােনা’ নামে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। 


৬. পর্যটন শিল্পের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্পের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পে বিপুল সম্ভাবনাময় অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত দেশ। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পকে বিকাশের জন্য উন্নত প্রযুক্তি বা উচ্চ মূলধনের প্রয়ােজন নেই। বরং দেশে বিদ্যমান। প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট সুবিধাদি দ্বারাই এ শিল্পকে উন্নততর করে তােলা যায়, যা দেশের কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র বিমােচন, রপ্তানি বৃদ্ধি ও জাতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। আর সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংযােজিত হতে পারে এক নতুন ধারা। 


৭. প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সম্ভাবনা : 

বাংলাদেশের মতাে কৃষিনির্ভর ও শিল্পকাঙ্ক্ষিত দেশের জন্য সব সময় উন্নত প্রযুক্তির লাগসই ব্যবহার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। নােবেল বিজয়ী অধ্যাপক রবার্ট শােলাে প্রমাণ করেছেন যে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে পুঁজি ও শ্রমের অবদানের তুলনায় প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং এর যথােপযুক্ত ব্যবহারের অবদান অনেক বেশি। তাই বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীর অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মােকাবিলা করতে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে।



৮. হস্তশিল্পের সম্ভাবনা : 

কারুশিল্পের প্রসারের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরাে এবং বাংলাক্রাফট-এর যৌথ উদ্যোগে আয়ােজিত জাতীয় কারুপণ্য প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ হস্তশিল্প প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি জানান, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে হস্তশিল্পের বিশাল চাহিদা রয়েছে। তাই সরকারের যথাযথ ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে হস্তশিল্পের ভূমিকাকে আরাে সম্প্রসারিত করতে পারে। 


৯. তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন : 

বর্তমান বিশ্বে এমন কোনাে শিল্প বা প্রযুক্তি নেই, যা কোনাে না কোনােভাবে কম্পিউটারের সাথে সম্পৃক্ত নয়। বর্তমানে রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলােচিত বিষয় কম্পিউটার সফটওয়্যার। কম্পিউটার সফটওয়্যার রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ইতিমধ্যেই কম্পিউটার সফটওয়্যার খাতকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে ঘােষণা দিয়েছেন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর থেকে জাতীয় রাজস্ব বাজেটে কম্পিউটারকে ‘শুল্ক ও ভ্যাটমুক্ত পণ্য ঘােষণা করেছেন। তাই আশা করা যায়, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশ দ্বারা বাংলাদেশের বিশাল মানবসম্পদ উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে। 


১০.উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা : 

যে কোনাে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। যােগাযােগ ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করতে পারে। যােগাযােগ ব্যবস্থার প্রভাব দেশের রাজস্ব আদায়, কৃষি ও শিল্প উন্নয়ন এবং সুষম অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষভাবে পড়ে। তাই একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সমাপ্তি আমাদের মতাে উন্নয়নশীল দেশের জন্য এক বিশেষ আশীর্বাদ।পদ্মা সেতু, পাকশী সেতু, রূপসা সেতু ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেতু প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও যােগাযােগ ব্যবস্থায় একটা সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হবে।। 



সার্বিক আলােচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়:

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যেমন রয়েছে অসংখ্য সমস্যা, তেমনি রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। তবে বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতি প্রায় একটি অভিন্ন অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ইতােমধ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ। রাষ্ট্র মুক্তবাজার অর্থনীতি গ্রহণ করেছে। তাই বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় কোনাে দেশের পক্ষেই এককভাবে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সহযােগিতার। পাশাপাশি রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ও বিরােধী দলকে শুধু দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি ও ইস্যুতে ঐকমত্যভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments